জিনোম ৩

সচরাচর আমার মন খারাপ হয়ে দীর্ঘস্থায়ি হয় না। এবার হলো। আমি মন খারাপ করে দুদিন কোন কথা বল্লাম না। ঘরের কোনে চুপকরে বসে রইলাম। মা খাবার জন্য ডাক দিচ্ছে সেদিকেও তেমন কোন আগ্রহ নেই। ব্রিলিয়ান্ট না হবার কারনে হয়তো আমি কোন কিছু সহজে নিতে পারি না। আমার মাথার ভেতরের নিউরনে লম্বা সময় অতিবাহিত হয় সুক্ষ্ম ব্যপারগুলো এডজাস্ট করতে। 

সামান্থার মেইলের এটাচমেন্ট ফাইলগুলো দেখলাম। সেখানে তার রিসার্চের অনেক ডকুমেন্ট রয়েছে। একটা ডকুমেন্ট এর উপরে লেখা আছে “টপ সিক্রেট”। এটি খুলতে চাইলে দেখলাম এতে পাসওয়ার্ড প্রটেক্ট করা। কিন্তু কোথাও পাসওয়ার্ড এর কোন হিংস পেলাম না। তাই ওটার আশা বাদ দিয়ে অন্য ডকুমেন্টগুলো ভালো করে লক্ষ করলাম। করোনাভাইরাসের উপর গত দশ বছরের বিভিন্ন গবেষনার ফলাফল, বিভিন্ন বিশ্লেষন, বিভিন্ন তথ্য দেয়া আছে। কিছু কিছু তথ্য আমাকে বিস্মিত করলো। 

কয়েকটি তথ্য এমন-

— প্রায় ৪ বছর হলো করোনা নামক একটি মারন ভাইরাস উপর্যুপরি মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অসহায় ভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে এই ক্ষুদ্র ভাইরাসটির কাছে শক্তিশালি মানুষ আজ অসহায়। এটি এতটাই মারাত্মক যে পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করেও এদেরকে কিছুই করা যাচ্ছে না। 

— গত ৭ বছরে পৃথিবী ক্রমশ মানব শূন্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। গোপন একটি মাধ্যমে তথ্য পেলাম করোনাভাউরাস নিয়ে গবেষনায় নিয়োজিত মানুষগুলো দ্রুত মৃত্যুর মুখে ঢলে পরছে। অত্যাধুনিক পোষাকও তাদেরকে রক্ষা করতে পারছে না। কি এক অভিনব পদ্ধতিতে সেফটি জারের ভেতরে রাখা ভাইরাসের সেম্পলগুলো বাইরে বেড়িয়ে এসে আক্রান্ত করছে সবাইকে। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এখনো এ ব্যপারে কিছুই জানেনা। শুধু গবেষনা সংশ্লিষ্ট ও  সর্বোচ্চ কাউন্সিলের কর্তা ব্যক্তিরা ছাড়া।

— বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষনা প্রতিষ্ঠানটি (ইইসিইউ) এতি মধ্যে তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিজ্ঞানী এবং কর্মীদের হারিয়েছে। বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

— শেষ পর্যন্ত ইইসিইউ বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদিও গোপন সুত্রে জানা গেছে ইইসিইউ বন্ধ করা হয়নি, মুলত এটিকে আরো শক্তিশালি করে অতি গোপনে এবং আন্তর্জাাতিক মানের ল্যাবরেটরিতে রুপান্তর করে খুব গোপন স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এবং সেখানে নতুন নিয়মে কাজ শুরু হয়েছে। ব্যপারটি আশা ব্যঞ্জক হলেও অতি গোপন একটি তথ্য আমাকে বিচলিত করছে।

— গত আট বছর করোনা জিনোম এর উপর অসংখ্য গবেষনা করেছে পৃথিবীর হাজার হাজার ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা। এ দীর্ঘ সময়ের গবেষনা এবং প্রচেষ্টার ফলে যা যা হয়েছে-

–১। করোনা এ পর্যন্ত প্রায় ৪৩২১ বার  তার জিনের মধ্যে পরিবর্তন করে নিয়েছে।  কারন, এর জিনোমের প্রথম দুই-তৃতীয়াংশ ট্রান্সক্রিপটেজ পলিপ্রোটিন এনকোড করে। ট্রান্সক্রিপটেজ পলিপ্রোটিন নিজে থেকেই ভেঙে গিয়ে অ-গাঠনিক প্রোটিন গঠন করে।

–২। যতবার এর ভেকসিন তৈরী করা প্রয়োগ করা হয়েছে ততবারই সেই ভেকসিনের এন্ট্রিবায়োটিক কোডগুলোকে সে নিজের জিনোমের সাথে এডজাষ্ট করে নিয়েছে।

–৩। প্রথম দিকে বিভিন্ন পরিবেশে করোনা বেচে থাকায় ঝুকি ছিলো। যেমন ২২ ডিগ্রি সে: তাপমাত্রার উপরে। সাবান কিংবা ক্ষার যাতীয় কিছু সংস্পর্শে। কিন্তু এখন এসব পরিবেশে ভালো ভাবেই বেচে থাকতে পারছে এরা। 

–৪। ভয়ংকর ব্যপার হলো প্রথম পর্যায়ে করোনা আকারের চাইতে ভারি হওয়াতে বাতাসে মাধ্যমে ছড়াতে পারতোনা। কোননা কোন বাহকের মাধ্যমে এটি ছড়াতো। কিন্তু এখন তাদের ওজন আগের চাইতে তুলনামুলক কমে যাওয়াতে এরা এখন বাতাসের মাধ্যমেও কিছুদুর পর্যন্ত ছড়িয়ে পরতে পারে।

#

গত ক’বছরে আমি এই ভাইরাসটি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা এবং খোজখবর নিয়েছি। বলা যায় গবেষনা করেছি। যদিও আমি গবেষক নই। কিন্তু আমি অনেক কিছুই কিভাবে জেনো সহজে বুঝতে পেরে যাই। বেশ কিছু ব্যপার আমার মাথায় এসেছে। ভাইরাসটির জিনোম নিয়ে আমি প্রচুর গবেষনা করেছি আমার নিজস্ব ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে। আমার কেনো যেনো মনে হয়েছে ভাইরাসটিকে আমরা যে পথে দমন করতে চাচ্ছি সে পথে আমরা সফল হবোনা। আমাদেরকে অন্য কোন পথ দেখতে হবে। আমার মাথায় বার বার একটি বিষয় আসছে আসছে করেও আসছে না। আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে সহজ কোন পথ রয়েছে।

#

আমি জানি পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য বিশ্বের সকল উন্নত মাথাগুলো এক করে SOW নামের একটি প্রতিষ্ঠানে পৃথিবীর সকল শক্তি এবং অর্থ ব্যায় করে কাজ করে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ওরা প্রতিটি দেশে একটি করে ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেছে। গোপন সংস্থাটি দেশের ভালো মানের বিজ্ঞানী এবং ডাক্তার সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের খুজে বের করে নিয়ে আসছে সেই অতি গোপন SOW এ। 

#

লক্ষ করলাম বেশ ক বছর ধরে ওরা অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক এবং মেধায় অত্যান্ত জিনিয়াসদেরকে ডেকে নিচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারছিলামনা ওরা কি করে মানুষগুলোকে খুজে বের করছে। কিন্তু যখন আমার পরিচিত কিছু মানুষদেরকে ওরা ডেকে নিলো তখন চিন্তা করার প্রয়াশ পেলাম। দেখলাম যাদেরকে ওরা ডেকে নিচ্ছে তাদের বয়সের যেমন একটা মিল রয়েছে তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে ওরা অনেক মেধাবী। বিশেষ করে ওদের অনলাইন ডাটা বেইজ এবং ব্লগগুলোতে ওদের অস্বাভাবিক মেধার পরিচয় পাওয়া যায়।

#

—মনে হচ্ছে উচ্চ মাত্রার একটি ল্যাবরেটরি এবং কিছু তুখোড় ব্রিলিয়ান্ট পেলে আমি করোনার ভেকসিন নিয়ে আমার মনে উকি দেয়া অজানা ভাবনাগুলোকে বাস্তবে রুপ দিতে পারবো। 

##

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম আমি তাদের সাথে যোগ দেবো। যদিও জানি এটা আমার একটা সুইসাইড সিদ্ধান্ত। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। চারিদিকের হাহাকার দেখে দেখে মরার চাইতে চেষ্টা করে মরা অনেক ভালো। এখন জানি আমি কি করলে আমাকে তারা ডেকে নিবে। সে অনুায়ী আজ আমি করোনার জিনোম এর উপর করা গবেষনার একটা অংশ অনলাইনে সাবমিট করাবো।

#

কি আশ্চার্য আমার আর্টিক্যাল পোষ্ট করার ৩ ঘন্টা অতিক্রম করেছি। রাত ৩:১৭ তে পোস্ট দিয়ে ঘুমাতে গিয়েছি, সকাল ৬টায় মেইল চলে এসেছে। 

অতিমাত্রায় বিস্ময় নিয়ে সামান্থার পাঠানো তথ্যগুলো পড়া শেষ করলাম। গত কদিন বেশির ভাগ সময় ভেবে কাটিয়েছি। অল্প ঘুম হয়েছে, কিন্তু ছাড়া ছাড়া স্বপ্নর মধ্য দিয়ে। মানুষের প্রতি, জাতীর প্রতি কতটুকু ডেডিকেডেট হলে মানুষ এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে? নিজেকেই প্রশ্ন করছি। সামান্থা ইচ্ছে করে সুইসাইড স্টেপ নিয়েছে। অবশ্য এটা নেয়ার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা এবং যোগ্যতা ওর আছে। 

কিন্তু বুঝে পাচ্ছিনা সামান্থা এগুলো আমাকে জানালো কেনো? কেনো সে আবেগ দিয়ে চিঠিটা লেখলো? চিঠিটা আমি এপর্যন্ত কয়েকবার পড়েছি। আমি বুঝতে পারি সে যাওয়ার আগে আমার প্রতি তার আগ্রহ বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু কেনো?

আমার যদি তার মতো মেধা থাকতো তবে হয়তো এমন একটি কাজে অংশ নেয়ার জন্য আমিও চেষ্টা করতে পারতাম। হয়তো সেই সুবাদে তার সাথে দেখা হবারও একটা সুযোগ হতো। কিন্তু এখন আমিতো কিছুই করতে পারবো না।

দিন কাটছে চরম অস্থিরতা নিয়ে। চিঠির কথাগুলো আমাকে উপর্যুপরি অসুস্থ করে ফেলছে। ‌ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরলাম। ঘুমের মধ্যেও শান্তি নেই। স্বপ্নে জগতে চলে গেলাম।

-বিশাল এক ল্যাবরেটরি। বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরী করা হয়েছে বিশাল এক গবেষনার জগত। অসংখ্য মানুষ সেখানে ব্যস্ততম সময় কাটাচ্ছে। গবেষনা করে বের করার চেষ্টা করছে পৃথিবীতে মানুষ বেচে থাকার রক্ষা কবচ। হঠাৎ করেই একপলক চোখে পরলো সামান্থাকে। দুগ্ধ ফেনিল পোষাকে তাকে অপার্থিব কিছু বলে মনে হচ্ছে। গভির মনোযোগ দিয়ে ডেস্কে বসে মাইক্রোস্কোপ এর ছোট্ট ফানেলে চোখ লাগিয়ে কি যেনো পর্যবেক্ষন করছে। হঠাৎ করেই কাজ থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। অবাক হয়ে দেখলাম সে আমাকে হাতের ইশারায় ডাকছে। আমি বল্লাম, আমিতো আসতে পারবো না। দেখোনা শক্ত কাচেঁর দেয়াল। সে তখন আমাকে লক্ষ করে বললো- কে বলেছে পারবে না? পারবে। চেষ্টা করো। আমি বিস্ময়ে বল্লাম- কি করে পারবো। সে উত্তরে বলল- পারবে, চেষ্টা করো।

ঘুম ভাংগার পরও মাথা থেকে “চেষ্টা করো” কথাটা যাচ্ছেনা। বার বার মাথায় বাজছে। 

মা রাতের খাবার খেতে ডাকছে। 

  • খেয়ে যা, দুপুরে কিছু খাসনি।
  • ক্ষিধে নেই মা, তুমি খেয়ে নেও।
  • খেতে আয়, না খেয়ে থাকলে কোন লাভ হবে না। ভাবনা চিন্তা করতে ব্রেনের অনেক এনার্জি খরচ হয়। আর সেই এনার্জি আসে খাওয়া থেকে। না খেয়ে থাকা মানে তোর চিন্তাগুলোকে দুর্বল করে দেয়া।

আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মা কি কোন ভাবে আমার মনের কথাগুলো রিড করতে পারছে? সেকি কোনভাবে বুঝতে পারছে আমি কোন বিষয় নিয়ে খুব চিন্তিত?

  • হ্যা, আমি জানি তুই সামান্থার চলে যাওয়া নিয়ে ভাবছিস, সাথে সাথে সময়ের এই দুর্যোগ মুহুর্তে তোর কি করা উচিত তা নিয়েও ভাবছিস। আমাদের মা’দের অনেক কিছুই বুঝতে হয়। এখন আয়, খেতে আয়।

আমি আবারো অবাক হলাম আমার মনে কথাগুলো ঠিক ঠিক আম্মু বুঝতে পারছে দেখে।

আম্মুর পেছন পেছন আমাদের ছোট্ট ডাইনিং রুমে ঢুকলাম। দুজন থাকি বাসায়। বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রায় ৪ বছর আগেই। মা একটা আন্তর্জাতিক এনজিওতে কাজ করে।  বেশিরভাগ এনজিও গুলো অনলাইন বেইজড হওয়াতে এখন বাসায় বসেই কাজ করা যায়। বাইরে যেতে হয় না। 

  • মা, আমি কেনো অন্যদের মতো মেধাবি হলাম না? আমি কেনো জটিল কিছু বুঝিনা?
  • কে বললো তুই জটিল কিছু ভাবতে পারিস না? কদিন ধরেতো ভাবছিস?
  • মা, তুমি কি করে জানো আমি জটিল কিছু ভাবতে চেষ্টা করছি? 

আমি বিস্ময়ে অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। 

  • আরিয়ান, তুই এখন বড় হয়েছিস। নিজের ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছিস। এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে তোকে নিয়ে আমি এ পর্যন্ত এসেছি। আমাকে অনেক কিছুই করতে হয়েছে। অনেক কিছুই জানতে হয়েছে। খাওয়া শেষ কর। এখন আর কোন কথা না।

আমি দ্রুত খাওয়া শেষ করলাম। গোছানে শেষ করে আম্মু আমাকে নিয়ে তার ঘরে গেলেন। আমার খুবই পরিচিত ঘর এটি। কিন্তু আজ মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলাম। এঘরে আমি আসিনা বল্লেই চলে। মা সারাাদিন তার অফিসের কাজ করে কম্পিউটার বসে। আমার হাত ধরে আম্মু বিছায় গিয়ে বসলো। আমার মাথায় হাত দিয়ে আমার এলামেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলো।

  • তোর আব্বু একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। Behavioural genetics এর উপর গবেষনা করতেন তিনি। আর আমি তোর আব্বু মারা যাবার পুর্ব পর্যন্ত তার সহায়ক হিসেবে গত প্রায় ১১ বছর কাজ করেছি। আমরা দুজনেই West Virginia University তে একসাথে রিসার্চ করেছি। একটি বিশেষ কারনে আমরা আমাদের রিসার্চ শেষ না করেই দেশে চলে আসি। আমাদের রিসার্চ সংক্রান্ত সকল রেকর্ড গোপন করে আমরা সাধারণ জীবন যাপন করতাম। তোর আব্বু অবশ্য বাসায় তার নিজস্ব ল্যাবরেটরীতে গবেষনা করতো। কিন্তু এটা আমরা অন্য সবার কাছ থেকে গোপন রেখেছিলাম।

আমি অবাক হয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে আমার সামনে সম্পুর্ণ নতুন একজন মানুষ বসে আছে। এমন তথ্য কি করে আমার কাছ থেকে এতোদিন আড়াল করে রাখলো আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। চোখের সামনে সহজ সরল আব্বুল মুখটা ভেসে উঠলো। আমি জানতাম আব্বু তেমন কোন কাজ করেন না। আব্বু তার নিজের রুমে বসে রাত দিন কি নিয়ে যেনো পরে থাকতো। আমি এ নিয়ে তেমন কোন মাথা ঘামাতামনা। 

  • তোমরা আমার কাছ থেকে এগুলো লুকিয়ে রেখেছিলে কেনো?
  • তোর আব্বু জিন তত্বের আচার আচরন নিয়ে গবেষনা করতেন। গবেষনার এক পর্যায়ে তিনি  জিনোম এর কিছু আশ্চার্যকর বৈশিষ্ট্য আবিস্কার করেন। এ আবিস্কার প্রচলিত বেশির ভাগ আবিস্কারকে ভুল প্রমান করে। সে সময় আমরা West Virginia জেনেটিক ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ করছি। তোর বয়স তখন মাত্র ৫ বছর। তোর আব্বু চাইলো তার এ আবিস্কারটি সবাইকে জানাতে। আমাদের সামনে মাত্র ৪ মাসের সময় বাকি। এর মধ্যেই রিসার্চ জমা দিতে হবে। হঠাৎ করে আমি বেকে বসলাম। তোর আব্বুকে বল্লাম রিসার্চ জমা না দিতে এবং দেশে ফিরে আসতে। 
  • কেনো আম্মু? তুমি কেন এমনটি করতে চাইলে?
  • কারণ সেই সময় আমার দু সেমিস্টার আগে আমার এক বন্ধু Human Phycology এর উপর রিসার্চ জমা দেয়। সেটি চলমান কিছু বিষয়ের সার্থে কিছুটা সাংঘষ্টিক ছিলো। কিন্তু ইউনিভার্সিটি তার রিসার্চকে এপ্রুভ করে নেয়। এরপর শুরু হয় সাড়া পৃথিবী জুড়ে হৈচৈ। এক পর্যায়ে ইউনির্ভাসির্টি উভয় সংকটে পরে যায়। শেষ পর্যন্ত তারা সে রিসার্চকে স্থগিত করে দেয়। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। সে রিসার্চ এর সাথে জড়িত ৬ জনই পরবর্তি কয়েক দিনের মধ্যে মারা যায়। তোর আব্বুল রিসার্চ ছিলো আরো ভয়বহ রকমের তথ্যসম্মবিলত। আমি তোর আব্বুকে বোঝালাম। আমার ভবিষ্যতের কথা বল্লাম। বিশেষ করে তোর কথা বল্লাম। তোর আব্বু এরপর আর দ্বিমত করেননি। তখন আমরা সব গুটিয়ে দেশে বলে আসি।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমার আম্মুর দিকে। শুধু মাত্র আমার নিরাপত্তার জন্য জীবনের সব চাইতে বড় আবিস্কার গোপন রেখেছেন। আমার আব্বুর মুখটা চোখে ভেসে উঠলো। 

  • আব্বু মারা গেলেন কিভাবে? সবার মতো আমিও জানি আব্বু ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
  • হ্যা, তোর আব্বু ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েই মারা গেছেন। কিন্তু সাধারণ কোন ফ্লু নয়।
  • তবে কি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিরো আব্বু?
  • আমরা যখন দেশে ফিরে আসি তখন জীবিকার তাগিদে আমাকে বাইরে চাকুরী নিতে হয়েছে। তোর আব্বু নিজ ঘরে ল্যাবরেটরি বানিয়ে গবেষনায় মন দিলেন। আমাদের অসমাপ্ত রিচার্স শেষ করার জন্য প্রান পন চেষ্টা করতে লাগলেন। যেহেতু এখানে উন্নত ল্যাব এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থা নেই সেহেতু তার কাজ অনেকটা ধীর হয়ে এলো। আমার একার চাকুরীর আয়ে সংসার এবং তোর স্কুলের খরচের পর গবেষনার চালানোর জন্য কিছু থাকে না। এরি মধ্যে পৃথিবীতে এলো করোনা নামের মারন ভাইরাস। তোর আব্বু সিদ্ধান্ত নিলো তার জীবনের সকল পরিশ্রম এবং মেধা সে লাগাবে করোনার উপর গবেষনা করে। শুরু হলো তোর আব্বুর পরিশ্রমের জীবন। রাত দিন করোনার সকল জিনোম ডায়াগ্রাম, এর ইনভেলপ, আক্রান্ত ব্যক্তিদের সিমটম, সহ সকল কিছু নিয়ে গবেষনা শুরু হলো। এক পর্যায়ে করোনা ভাইরাস এর সেম্পল জোগাড় করে নিয়ে আসা হলো আমাদের ল্যাবরেটরিতে। কিন্তু যেহেতু এটি একটি মারাত্মক ভাইরাস সেহেতু এর জন্য সর্বচ্চ প্রটেকশন ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলো। আমরা কোন ভাবে কাজ চালাতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমরা আশ্চার্য হয়ে লক্ষ্য করলাম আমাদের রিসার্চ করা সবগুলো থিউরী সত্য প্রমান করছে এই করোনা ভাইরাস। আমরা আগ্রহী হয়ে উঠলাম। বিশেষ করে তোর আব্বুর আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে আমাদেরকে থামতেই হলো। কারণ যে বিশেষ কিছু যন্ত্র এবং ব্যবস্থাপনাগুলো দিয়ে এ ভাইরাসের জিনোম বায়ো ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে সেগুলো যোগাড় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
  • তখন কি করলে তোমরা? গবেষনা থামিয়ে দিলে?
  • গবেষনা অবশ্য আমরা থামাইনি। কোন রকমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আজ থেকে প্রায় ৫ বছর আগে তখন তোর বয়স ১৫ কি ১ে৬ বছর। এস.এসসি পরীক্ষা শেষ করেছিস। তোর কিছু বন্ধু এলো আমাদের বাসায়। তাদের সাথে সামান্থাও এলো। তোর বন্ধুরা যতখন ছিল আমাদের বাসায় ততক্ষণে কয়েকবার সামান্থা তোর আব্বুর ল্যাবরেটরিতে উকি মারলো চরম কৌতুহলে। পরদিন তুই তখন বাসায় নেই, সামান্থা আবার এলো আমাদের বাসায়। সে এসেই তোর আব্বুর ল্যাবরেটরিতে গেলো। তোর আব্বু যদিও বাইরের কেউ ল্যাবরেটরিতে আসুক এটা পছন্দ করত না, কিন্তু তারপরো মেয়েটার আচরেনে এমন কিছু ছিলো যে তাকে না করতে পারলো না।
  • এখানে কি নিয়ে গবেষনা করেন আপনি? _সামান্থা।
  • এই ছোট মেয়ে, তুমিকি বুঝবে আমার গবেষনার বিষয় সম্পর্কে বললে? _তোর আব্বু।
  • আমি ছোট না আংকেল, আমার বয়স ফিফটিন প্লাস। তাছাড়া এবার আমি এস.এসসি’তে বোর্ড ষ্ট্যান্ড করেছি।  আমাকে বলতে পারেন। আমি বুঝবো। _সামান্থা।
  • তবু্ও, এগুলো বুঝতে হলে তোমাকে আরো কিছুটা বড় হতে হবে।
  • আমি জানিনা আংকেল আর কত বড় হবার কথা আপনি বলছেন, আর কেনই বা বলছেন। কিন্তু এটা বলতে পারি আপনার টেবিলের উপর কিউবিক সন্ট্রির যে জারটা আছে সে জারটা ২৭ থেকে ৩৬ কিলোবেইস আকারের করোনা  ভাইরাসকে আটকে রাখার ক্ষমতা রাখে না। এটা রিস্কি।

এ কথা শুনার সাথে সাথে তোর আব্বু আৎকে দুই হাত পেছনে চলে যায়। দুচোখ বিস্ফারিত করে সামান্থার দিকে তাকিয়ে থাকে। এদিকে সামান্থা বলে চলেছে-

  • টেন্থ জেনারেশনের কোর এলেভেন প্রসেসর এর যে কম্পিউটার আপনি রিসার্চ এর ডায়াগ্রাম লুপিং এবং ডিকোডিং এ ব্যবহার করছেন তা আপনাকে সঠিক মাত্রায় ফলাফল দিতে পারবে না। 

আর আপনার Electron SU9000 মডেল এর মাইক্রোসকোপ দিয়ে নিউক্লিওক্যাপসিডকে এনকোড করে সঠিক  রিডিং ফ্রেম বের করে দিতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।

  • এ পর্যায়ে তোর বাবা সামান্থার হাত খপ করে ধরে জোড় করে নিয়ে চেয়ারে বসায়। অনেকখন তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তখন তোর বাবার সাথেই ছিলাম। আমাকে লক্ষ করে তোর বাবা বলে-
  • এই মেয়ে কি বলছে আরিয়ানের মা? তুমি কি কিছু বুঝতে পারছো?
  • আমি বল্লাম, হ্যা আমি জানি মেয়েটি কি বলছে। কারণ মেয়েটি অন্য সাধারণ মানুষের মতো না। গতকাল যখন ও আমাদের বাসায় এসেছে বার বার তোমার ল্যাবরেটরিতে উকি দিচ্ছিলো তখনই আমার কৌতুহল হয়, অন্য সবাই আড্ডায় ব্যাস্ত অথচ এই মেয়ে তার সকল মনোযোগ দিয়ে ল্যাবরেটরিতে কৌতুহল নিয়ে যাবে কেনো? আমি গতকাল রাতেই সামান্থার অনলাইন প্রোফাইল দেখি। খুব বেশি আশ্চার্য হবার কোন তথ্য সেখানে নেই। দুবার বোর্ড ষ্ট্যান্ড করেছে আর আরটিফিশিয়াল  জেনেটিক্স এর দুটি ওয়ার্ক শপে সে নেশনাল এয়ার্ড অর্জন করেছে। এ তথ্যগুলো খুব বেশি চোখে পরার মতো কিছু না। কিন্তু আমার কৌতুহল হলো আরো কিছু জানার জন্য। তাই আমি আমার অর্জানাইজেশেনের সিনিয়র সাইবার স্পেশালিষ্টকে কাজে লাগালাম। তখন জানলাম এই মেয়ে ইতিমধ্যে জেনেটিক্স এর মধ্যকার প্রোটিনের ইনক্রিপটেড ডাটাকে প্রায় ৬০% ট্রান্সক্রিপ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল একটি অতি গোপনীয় ফ্রেমওয়ার্কে সে এই তথ্যর উপর একটি স্ক্রিপ্ট জমা দিয়েছে।

পরবর্তী পর্ব: জিনোম-৪

Previous Article

জিনোম ২

Write a Comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe to our Newsletter

Subscribe to our email newsletter to get the latest posts delivered right to your email.
Pure inspiration, zero spam ✨