E-1 আমার বরাবর পছন্দের সীট।
বাসে পাঁচ নম্বর লাইনে বা পাশের প্রথম সীট টি এটি।
কক্সবাজার এবারই প্রথম একা যাচ্ছিনা। কিন্তু এবারের যাওয়াটা একটু অন্যরকম।
শেষ প্রজেক্টটি জমা দিয়েছি চারদিন আগে। গত ৩ মাস হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম গেছে প্রজেক্টটি শেষ করতে। অনেক কষ্ট করে শেষ করেছি কাজটা। যদিও এর বিনিময়ে অল্প কিছু টাকা পেয়েছি। কিন্তু আমার মতো গরিবের জন্য তিন মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা অনেক টাকা। অবশ্য বস অর্থাৎ আমাকে যে কাজ দেন তিনি বলেছিলেন কাজ পছন্দ হলে আমাকে একটা সারপ্রাইজ দিবেন। গত-পরশু টাকা দেবার সময় কাজ পছন্দ হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে হ্যা-না কিছুই বলেনি। মনে মনে “শালা” বলে গালি দিয়ে এসেছি।
প্রয়োজনীয় কাজ সেরে গতকাল একটু রিলাক্স ঘুরে বেড়িয়েছি। মানুষের পাওনা পরিশোধ করে আরো অর্ধেক টাকা রইলো। উড়ো মন উড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে আমার জীবনের একমাত্র শখ “ঘুড়াঘুড়ি”র দিক থেকে জোড় করে মন সারিয়ে রাখছি। তাছাড়া বস বলেছে আগামী সপ্তাহে আরো একটা কাজ শুরু হবে। তার জন্য প্রস্তুত হবার জন্য।
সেলিম আমার বস। অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের আউটসোর্সিং কাজের ব্যবস্থা উনিই আমাকে করে দেন। মানুষটা খুব কম কথা বলেন। সব চাইতে বড় কথা হলো আমরা এক সময় একই সাথে পড়ালেখা করেছি। সময়ের পরিক্রমায় ওর আর আমার অবস্থান ভিন্ন হয়েছে।
গতকাল দুপুরে বিছানায় অলস গড়াগড়ি করছি। টুং করে মেইল আসার নোটিফিকেশনে পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইনবক্স খুললাম। বস পাঠিয়েছে। ছোট্ট একটা মেসেজ-
আরিয়ান,
ই১ তোমার প্রিয় সীট, আমি জানি।
আগামীকাল রাত ১১:৫০ ঢাকা শান্তিনগর থেকে বাস ছাড়বে।
স্কেনিয়া ডবলডেকারগুলো দেখার চাইতে চরতে আরো আনন্দের।
একাউন্টে কক্সবাজার ট্যুর বাবদ পনেরো হাজার টাকা দিয়েছি।
বি:দ্র: আগামী প্রজেক্টটা এবারেরটার মতো সুপার না হলে তোর কপালে খারাবি আছে শালা।
দুচোখ কপালে উঠিয়ে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামলাম। সত্যিই বস আমাকে এতোবড় সারপ্রাইজ দেবে চিন্তায় আসেনি। বাসের টিকেটটা খুলে দেখে কনফার্ম হলাম ব্যপারটা স্বপ্ন নয়। অবশ্য আমার জন্য ডবলডেকারে রাইড করা মানে গরিবের হেলিকপ্টারে চরার মতো।
বিকালেই ট্যুরের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড় ও অন্যান্য জিনিসের একটি লিস্ট তৈরী করে ফেল্লাম। কাপড় ছাড়া অন্যান্য জিনিস আমার সব রেডিই থাকে। যেহেতু আমি একজন পাগলা ঘুরনবাজ।
**
বসে চলে এসেছি ১১:২০ এর মধ্যেই। হালকা শীত পরেছে। শীতের শুরুর রাতে বাইরে হাটলে সুন্দর একটা আমেজের স্পর্শ পাওয়া যায়। বাস থেকে নেমে কাছেই রাস্তার ধারে কাঠের টুলে বসে এককাপ লাল চা নিলাম হাতে। খুব আয়েশ করে ঠোটে ছোয়া লাগাচ্ছি কাপে। চোখের খুব কাছ থেকে কাপের চাহতে ধোঁয়া উপরের দিকে উঠতে থাকা দেখতে দেখতে আলতো চুমুক দিচ্ছি। সম্পুর্ণ উৎযাপন করে চা খাওয়ার অভ্যাস আমার আগে থেকেই। যাকে বলে আয়েশ করে খাওয়া। চারিদিকে দেখছি। বিশেষ করে শেষ মুহুর্তে অনেক যাত্রীই বাসে এসে উঠছে। পাশের বক্সে লাগেজ উঠাচ্ছে। তারপর দীর্ঘ যাত্রার জন্য মানুষিক প্রস্তুতি নিয়ে মন্থর পা রাখছে বাসের সিড়িতে।
বাস ছাড়ার ৫ মিনিট আগেই সিটে এসে বসলাম। ধীরে ধীরে বাস ছেড়ে দিচ্ছে। টিপটপ শার্ট টাই পড়া সুপারভাইজার সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন। কিছু উপদেশ দিলেন। বাস পুর্ণ গতিতে চলতে শুরু করেছে। আমার পাশের সীটটি খালি। মনে মনে খুশি হয়ে গেলাম। লম্বা সফরে হাতপা ছড়িয়ে যেতে পারবো ভেবে। কিন্তু সে সুখভাবনা আমার বেশিখন টিকলো না। শনির আখড়া থেকে একজন যাত্রী উঠলো। সম্বোবত আমার সহযাত্রীই হবে। কারণ বাসের অন্য কোন সীট খালি দেখিনি।
অনেকটা নিস্পৃহ ভাব নিয়েই একটু জানালার দিকে চেপে বসলাম। যাত্রী তার সাথে থাকা ব্যকপ্যাকটি উপরের বক্সে রাখছেন। তখনই খেয়াল করলাম তার দিকে। স্বপ্নেও ভাবিনি অমন লম্বা যাত্রায় কোন মেয়ের পাশে বসে থাকতে হবে। ব্যাগ সামলিয়ে সিটে বসলো সহযাত্রী। আড় চোখে মেয়েটাকে খেয়াল করার প্রয়াশ পেলাম। দেশ ভালোই এগিয়েছে। লম্বা দুরত্বে এবং রাতের বাসে একটি মেয়ে একা একা এমন জার্নি করতে পারে ভেবে অবাক হলাম। মেয়েটি এরি মধ্যে ফোনে কার সাথে যেনো কথা বলছে। সে বাসে উঠেছে এ তথ্যটা জানালো ওপ্রান্তের কাউকে। বাসের আলো কমিয়া রাখা, তাই ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা মেয়েটা কেমন বয়সের। তবে কন্ঠে অনুমান করলাম ২২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হতে পারে। অবশ্য আজকাল মেয়েদের বয়স বোঝা ভার।
ক্যাবলার মতো মেয়ের দিকে না তাকিয়ে হাতের হুয়াইয়ো ফোনের স্ক্রীনের দিকে মনোযোগ দিলাম। বাসের ওয়াইফাই কানেক্ট হয়ে তাদের বিশাল মেমোরিতে রাখা অডিও-ভিডিও গুলোতে আমার পছন্দের গান খুজতে লাগলাম। গজল লিস্ট থেকে একটি গান প্লে করলাম।
“বাহারো ফুল বারছা-ও মেরা মেহবুব আয়া হ্যা…..”
গঠাৎ করেই মনে হলো গর্ধবের মতো একটা কাজ করে ফেলেছি। এয়ারফোন জ্যাক না লাগিয়েই গান প্লে করে দিয়েছি। পাশে বসা মেয়েটি আলতো মুখ ঘুরিয়ে আমার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়েই পরক্ষনে ফিরিয়ে নিলো। আমি দ্রুত এয়ারফোন লাগালাম। মাথাটা এলিয়ে দিলাম পেছনে। দোতলায় হওয়াতে আশেপাশের অনেকদুর পর্যন্ত দেখা যায়। কিছুটা কাত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছি। বাস ইতোমধ্যে চিটাগাংরোড পেরিয়েছে।
স্বচ্ছ কাচেঁর ভেতর দিকে বাইরে তাকিয়ে আছি। গাতিশীল আলো গুলো দ্রুত পেছনে ছুটে যাচ্ছে। অদুরে গাড়ো কালো অন্ধকার থেকে বিচ্ছুরিত বিন্দু বিন্দু আলো কাচের উপর ধোয়াশা তৈরী করছে। আমি স্বাপ্নিক এক জগতে হারিয়ে গেলাম। হুন্দাই গাড়ির আরামদায়ক ঝাকুনি শরিরে মনে এক অভুতপুর্ব অনুভব তৈরি করছে। এগাড়ি গুলোর বৈশিষ্ট্য হলো এগুলোতে ঝাকি হয়না, যা হয় তাকে ঝাকি না বলে দুলুনি বলা যেতে পারে যেটা সাধারণত পানির মধ্যে হয়ে থাকে। এর উন্নতমানের হাইড্রোলিক স্প্রিং এর সাহায্যে ঝাকুনির বদলে দুলতে থাকে।
বাইরে এখনো কুয়াশা পড়েনি। তাই অন্ধকার ফুরে চাদেঁর স্বচ্ছ আলোয় উদ্ভাসিত চারিদিক। উপর থেকে বাঁকা রশ্মির মতো নেমে আসছে তির্যক চাদোয়া। আমি বিমহিত হয়ে তাকিয়ে থাকি প্রকৃতির এমন অপার্থিব সুন্দরের দিকে। আবেগিত হয়ে কখন যে আমার কপাল ঠেকিয়েছি গাড়ির জানালায় আমি নিজেই জানিনা। অবশ্য আমার এ পছন্দের স্থানটিতে আমি খুব দুর্বল। এর ভাগ আমি আর কাউকে দিতে চাইনা। পাশের সিটে বসা মেয়েটি যে গভির বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি ঘুর্নাক্ষরেও জানতে পারিনি।
– হ্যাল্লো, কোন সমস্যা?
চুড়ান্ত বিস্ময়কর এবং রিনরিন উচ্চারনে বলা কথাটি প্রথম বার যখন উচ্চারিত হলো তখনও আমি স্বপ্নের জগতে জড়িয়ে আছি।
– এই যে, আপনার কি কোন সমস্যা আছে?
আমার কাছ থেকে কোন প্রতুত্তর না পেয়ে আবারো আমার সহযাত্রী আমাকে লক্ষ করে প্রশ্ন করলো। আমি হঠাৎই বাস্তবে ফিরে এলাম। বুঝলাম আমার এভাবে বাঁকা হয়ে কাচেঁর গ্লাসের সাথে লেগে বসে থাকায় মেয়েটি ভেবেছে আমার কোন সমস্যা হচ্ছে হয়তো। আমি সোজা হয়ে বসলাম। এই প্রথম মেয়েটার মুখের দিকে সরাসরি তাকালাম। মাথার উপরের হালকা স্বাপ্নিল আলোয় তাকে পুরোপুরি দেখে নিলাম। মুহুর্তেই মনে হলো,
“এবেলায়, অনেক বেলায় আমার কোন বেলা নেই,
ফেলে আসা অনেক কিছুই,
আমার আসলে কিচ্ছু নেই।”
পেছনের লম্বা সময়ে যে প্রকৃতির, যে জোস্নার, যে সমুদ্রের, যে বনানীর সুন্দরের আরাধনা আমি করেছি মুহুর্তেই সেগুলো ম্লান করে দিয়েছে সামনে বসে থাকা ফুলের মতো বিকশিত একটি মানবী। আমি তার নাম দিয়ে দিয়েছি দেবি হয়তো, কিন্তু তাকে এ নামেও মানাবে না। আমার বিশেষনের ঝুলি খুজেঁ পেলামনা মানানসই আর কোন অলংকার।
আমি তাকিয়ে ছিলাম হয়তো ৪ সেকেন্ড। না, সহ্য করা গেলোনা। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে গভির নিস্বাস নিলাম। আমার উত্তর না পেয়ে মেয়েটি আমার দিকে কৌতুহলি দৃষ্টিতে এখনো তাকিয়ে আছে কিনা আমি জানিনা। কিন্তু এক মুহুর্ত আমার দুচোখে বাসের হালকা ইসৎ আলোয়ে যে মানুষটাকে দেখেছি সে অবয়ন পরিস্কার বসে গেছে আমার নিউরনে। আমি বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে গেলাম এই ভেবে যে, কিছুখন আগে আমার জীবনের সবচাইতে সুন্দরতম পরিবশে জোছনায় চারিদিক ভেসে যাওয়া দৃশ্যকে ম্লান করে দিয়েছে এ দেবি।
জানিনা তন্ত্রা কিনা। কিন্তু মনে হলো অন্য কোথাও থেকে ফিরে এলাম। দুচোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে দেখলাম আমার সহযাত্রী নেই। হা হা করে উঠলো হৃদয়। হলো কি। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে খেয়াল করলাম, বাসের মধ্যে প্রায় সব সিটই খালি। অর্থাৎ সে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। আর এরি মধ্যে যাত্রার মাঝের বিরতি দিয়ে কোথাও থেমেছে।
বাস থেকে বেরিয়ে এলাম। কুমিল্লা তাজমহল রেষ্টুরেন্ট। রাত প্রায় ১ টা। অথব রেষ্টুরেন্স এ প্রচুর ভিড়। ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসে ইচ্ছে হলো কোথাও বসে আয়েশ করি একমগ কফি খাই। কিন্তু নিরাশ হতে হলো যখন তাকিয়ে দেখলাম কোন টেবিল খালি নেই। কাউন্টারের সামনে গিয়েও দেখলাম একই অবস্থা, খাবারের জন্য লাইন দাড়িয়ে আছে। কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফিরে আসছিলাম। হঠাৎই মনে হলো কোনের দিকে জানালার পাশে দুজনের একটি টেবিল থেকে কেযেনো হাত নেড়ে কাকে যেনো দৃষ্টি আকর্শন করার চেষ্টা করছে। আমার হবার কথা নয় জেনেও হাতের মানুষটার দিকে তাকালাম। আবারো একটা হার্টবিট মিস করলাম যখন দেখলাম আমার সহযাত্রী আমার দিকে তাকিয়েই আমাকে হাত নেড়ে ডাকছেন। অনেকটা অপ্রস্তুত হয়েই ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। যাবার সময়ের পথটাকে মনে হলো বড্ড ছোট, আরো বড় হলেও হয়তো এসময়কার অনুভুতিটা অনেকখন ফিল করা যেতো।
– সেই কখন থেকে আপনাকে ডাকছি আপনি ওয়াশ রুম থেকে আসার পর থেকেই। আমি জানি এখানে সহজে টেবিল পাওয়া যায় না এমনকি খাবার পেতেও অনেকক্ষন অপেক্ষা করতে হয়। তাই আমি বাস থামতেই এসে টেবিল দখল দিয়ে কফির অর্ডার দিয়ে তারপর ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। বসুন, এক সাথে কফি খাই যদিনা আপনার কোন অসুবিধা হয়।
তুলতুলে নরম সোফায় আরামক করে বসলাম আমি। একবার কফিকাপ আরেকবার সহযাত্রীর দিতে তাকালাম। রেষ্টুরেন্ট এর ঝলমলে আলোয় সহযাত্রীকে এখন পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে। সৌন্দর্য প্রকাশের যন্য আমার মনে কখনো কোন আলাদা শব্দ তৈরী হয়নি। আমি কাজ করি প্রোগ্রামিং কোড নিয়ে। মাথায় কার্লিব্রাকেজ, কনকেট, লুপ, ফেচিং এর মতো উদ্ভট শব্দ ছাড়া অন্য কিছু সহজে আসে না। স্ফিত হেসে কফিকাপটা টেনে নিলাম। শীতের আমেজের সাথে গরম কফিটা মনে হলো সোনায় সোহাগা। আমি মাথা উচু করে সহযাত্রীর দিকে তাকালাম। স্ফিত হেসে বল্লাম-
– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো কফি খেতে। রাতের জার্নিতে ক্যাফেনটা অনেক কাজ দেয়।
– ধন্যবাদ দেয়ার মতো কিছু না। আমি বাস থেকে নামার সময় দেখে এসেছি আপনি ঘুমুচ্ছেন। তাই ডাকিনি। কিন্তু মনে হচ্ছিলো আপনি নেমে আসবেন তাই দুটো কফির অর্ডার দিয়েছিলাম অনেকটা লটারির মতো করে।
– আপনি লটারি ধরতে পছন্দ করেন?
– ঠিক তা নয়, আমি মানুষকে পর্যবেক্ষণ করতে পছন্দ করি। আমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। সেই ক্ষমতা এপ্লাই করেছি। যেমন এই মুহুর্তে বুঝতে পারছি আপনি অনেকটা দ্বিধা করে কফি খাচ্ছেন। কারণ হিসেবে বলা যায় অনেকটা সময় আমরা পাশাপাশি সিটে আছি কিন্তু কারো সাথে এখনো পর্যন্ত পরিচিত হয়নি কিন্তু তারপরো আপনাকে আমি কফির জন্য ডেকে বসালাম, এটা আপনার প্রোগ্রামার ব্রেনের স্বাভাবিক লুপিং সিস্টেম ডিকোড করতে পারছে না।
আমি অবাক হয়ে সামনে টেবিলের অপর পাশে চঞ্চল হরিনি দুটো চোখ ওয়ালা মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি। কথাগুলো এতো সুন্দর ভাবে উচ্চারিত হচ্ছে মনে হচ্ছে আগে থেকে স্ক্রিপ্ট লেখা ছিলো। কোন জড়তা কিংবা স্লেশ্যতা নেই। তাছাড়া কি স্পষ্ট নিঃসকোচে কথাগুলো বলছে যেগুলো অনুমান হলেও আসলেই সত্যি। মেয়েটা সোফায় হেলান দিয়ে কফিকাপ আলতো করে ঠোটেঁ ছোঁয়ালো। ঠোটেঁর কাছে কাপ যাবার মুহুর্তেই কিছু ফাকা হলো পিংক কালারের ঠোঁট দুটো। হাতের কাপটা টেবিলে রেখে আমি একটু নড়ে বসলাম।
– কিকরে বুঝলেন আমি প্রোগ্রামার?
– আপনি সত্যিই প্রোগ্রামার! এটাও আমি আমার অবজার্ভেশন থেকেই বলেছি।
– কিভাবে করলেন?
– এর জন্য বেশি কিছু জানা লাগে না। আপনার মোবাইলে যে টোনটা সেট করা এটি একটি জনপ্রিয় প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের থিমসং। তাছাড়া আপনি যে টি শার্টটি পড়ে আছেন সেটি কিছুদিন আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রোগ্রামিং মেলার আয়োজকদের জন্য নির্ধাারিত ড্রেসের অংশ।
– বলাই যায় আপনার অবজারভেশন পাওয়ার খুবই উন্নত। সম্ভোবত আমাদের পরিচিত হওয়া দরকার। আমি আরিয়ান, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে স্বাধিনতার জন্য ভাংকাচুড়া প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করছি।
স্ফিত হেসে আমি জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে বল্লাম সহযাত্রীকে। এরি মধ্যে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সময় প্রায় শেষ।
– আমি আলিভা। বেকার।
দুচোখে কৌতুক করে উত্তর দেয় আলিভা। সময় শেষ হওয়াতে দুজনেই উঠে দাড়াই। বাইরে বেরুতেই ঠান্ডার আচ লাগে মুখে। আমার কাছে ভালো লাগে এমনটা। হঠাৎ হঠাৎ ঠান্ডা এসে চোখে মুখে কোমল পরশ দিয়ে যায়। বাইরের করিডোরে কিছুখন দাড়িয়ে সকল যাত্রীকে একে একে বাসে উঠা দেখি। আলিভাও ইতিমধ্যে উঠে গেছে বাসে।
বাসে উঠে দেখি আলিভা সিটের বাইরে দাড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলাম বারবার দাড়ানোটা তার কাছে পছন্দের না, তাই আমাকে ভেতরের সিটে বসতে দিয় তারপর বসার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি দ্রুত গিয়ে আমার সিটে বসে পড়লাম।
গাড়ী আবারো পুর্ণ গতিতে চলতে শুরু করলো। আমি গা এলিয়ে দিলাম সিটে। কফি খাবার পর ঘুমের রেশটা অনেকটাই দুর হয়ে গেছে। কিন্তু সহযাত্রীকে নিয়ে কল্পনার রাজ্যে বিচরন করতে লাগলাম। কতই হবে বয়স তার, কিন্তু এই বয়সেই কতটা যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাছাড়া বাহ্যিক গঠন বিচারে আশ্চার্য হতেই হয় এমেয়ে এখনো একা? প্রশ্নই আসে না। কিছুটা আশাহত হই। চোখ খুলে আড় চোখে তাকাই পাশের সিটে। আলিভা সোজা হয়ে বসে তার মোবাইলে কি যেনো করছে। হঠাৎই আমাকে সোজা হতে দেখে আমার দিকে ফিরলো আলিভা-
– কি হলো, কোন সমস্যা?
– না।
– আপনি লেখাপড়া করেছেন কোন বিষয়ে?
– আমি সাইকোলজি নিয়ে পড়েছি। কেনো জিজ্ঞেস করছেন?
– না, এমনিতেই। এই কারনেই আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অনেক বেশি।
– লেখাপড়া করলেই এই ক্ষমতা বাড়ে? আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই যে কোন কিছু জানার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলাম। কেনো আপনিওতো নতুন কিছু জানতে আগ্রহী। যেভাবে হোটেলের ডেস্কের উপর রাখা বনসাইটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন মনে হচ্ছিলো রেটিনা দিয়ে স্কেন করছেন। কোন কিছু সঠিক উপায়ে অবজারভেশন করাটা একটা আর্ট। আর শিল্পীরা সচরাচর ভালো মনের মানুষ হয়।
আমি সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি মেয়েটার দিকে। কিছুটা আড় হয়ে বসে আমার দিকে ফিরে কথাগুলো বলছে সে। কথার মধ্যে সুন্দর শিল্পী মনের ছবি ভেসে উঠেছে। আমি পুর্ণাঙ্গভাবে তাকে দেখার প্রয়াস পেলাম। পিতাভ বর্ণের একটা জ্যাকেট পড়ে আছে যার হুডিটা মাথার উপ তুলে রাখা। নিচের অংশে সম্ভোবত কালো রংয়ের জিন্স পড়া। পায়ে কের্ডসগুলোও তার উন্নত রুচির পরিচয় দিচ্ছে। হাতের কব্জিতে থাকা আইওয়াচ এবং হাতে ধরে রাখা আইফোন এর কদিন আগে রিলিজ করা লেটেষ্ট মডেল প্রমান করে এমেয়ে সময়ের সাথে চলতে পছন্দ করে এবং সে সামর্থও তার আছে। চোখে দেয়া অত্যাধিক সুন্দর ডিজাইন এর চশমাটিতে বার বার চোখ আটকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সবকিছুতেই ওনার রুচির সাথে নোকম্প্রোমাইজ রয়েছে। এযাতীয় ব্যক্তিগুলো সচরাচর কাঠখোট্টা টাইপের হয়ে থাকে, কিন্তু ওনার মধ্যে তা দেখা যাচ্ছে না। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই মেয়েটি বলে উঠলো-
– কক্সবাজারে কোথায় উঠছেন?
– আমি সচরাচর আগে বুকিং দেইনা।
– তবে?
– আগে পৌছাবো, তারপর দেখে শুনে যেখানটায় আমার পছন্দ হয় ও সাধ্যে কুলায় সেখানেই ঘাটি গাঢ়বো।
– ওহ।
– আপনি কোথায় কোথায় উঠছেন?
– সি পার্ল।
– ওয়াও, খুবই সুন্দর রিসোর্ট। যদিও সাধ্যের কারনে কখনো ওখানে থাকা হয়নাই, কিন্তু দেখেছি। আসলে কক্সবাজারের সবগুলো বিচের মধ্যে ইনানী বিচ প্রথম থেকেই আমার খুব প্রিয়। হিমছড়ি দেখতে গিয়ে অনেকেই ইনানীতে যায় কিন্তু আমি ওখানে যাই শুধু ইনানীকেই উপলব্ধি করার জন্য। বিশেষ করে সন্ধেকালীন আবহটা ওখানে এতোটাই মুগ্ধকর যে আমি বার বার এর প্রেমে পরে যাই।
নতুন তৈরী রয়েল টিউলিপ সি পার্ল রিসোর্টটার অবস্থা্নও ইনানীর প্রান কেন্দ্রেই। অবস্থান এবং পরিবেশ যাচাইয়ে কক্সবাজারের সেরা জায়গা মনে হয় আমার এটা। বিশেষ করে রিসোর্ট এর প্রায় প্রতিটি রুম থেকে সাগরকে দেখা যায় পরিস্কার ভাবে। কিছু কিছু লাক্সারী রুম আছে সেগুলো সবগুলোই সাগরের দিকে মুখ করা বিশাল বেলকনি আর ফ্লোর থেকে কার্নিশ পর্যন্ত গ্লাসের জানালা। সেখান থেকে সাগরটাকে যে আসলেই অসম্ভব ভাবে অনুভব করা যায় তা আমি সেখানে না গিয়েও বুঝি।
আবেগের অতিসয্যায় আমি চোখ বন্ধ করে ফেল্লাম। মনে নেই সামনে একজন অনুসন্ধিৎসু দর্শক আমাকে অবজার্ভেশন করছে। মনে হতেই আমি চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলাম। দেখি অবাক হয়ে মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
– প্রকৃতির প্রতি মানুষ যে অনুরাগী এবং আগ্রহী এটা আমি জানি। এই প্রথম একজন প্রকৃতির প্রকৃত অন্ধ প্রেমিক দেখলাম যে কিনা প্রকৃতির কথা শুনলে আসলেই চোখ বন্ধ করে অন্ধ হয়ে যায়।
> <
বলেই হাসতে লাগলো আলিভা। আরিয়ানের চোখেও কৌতুহল। আর তেমন কথা হয়না ওদের মধ্যে। দুজনই মাথা এলিয়ে দেয় সীটে। চোখ বন্ধ করে বুক ভরে স্বাস টেনে নেয়।